সালাত আদায়ের গুরুত্ব ও ফজিলত

সালাত আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ দোয়া ,রহমত ,ইস্তেগফার, তাসবিহ ইত্যাদি।  শরীয়াতের পরিভাষায় সালাত বলতে বোঝায়, সালাত এমন কিছু শনির্ধারিত কথা ও কাজ বিশিষ্ট ইবাদত, যা তাকবিরের মাধ্যমে শুরু হয় এবং সালাম এর মাধ্যমে শেষ হয়। ইসলামের ৫ স্তম্ভের দ্বিতীয় স্তম্ভ সালাত। ফার্সি ভাষায় যাকে নামাজ বলা হয়। ঈমান ছাড়া অন্য চারটি রোকনের মধ্যে এটা সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। সালাত কে দীনের খুঁটি বলা হয়েছে। যেমন খুঁটি ছাড়া যেমন ঘর হয় না  তদ্রুপ সালাত ছাড়াও দীন পরিপূর্ণ হয় না। সালাত যে ফরজ তা অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত। মুমিন বালিগ পুরুষ মহিলা সকলের জন্যই তা আবশ্য পালনীয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, "তোমরা সালাত কায়েম করো ও যাকাত দাও এবং যারা রুকু করে তাদের সাথে রুকু কর।"( সূরা আল বারাকা ৪৩)নির্ধারিত নিশ্চয় নির্ধারিত সময় সালাত কায়েম করা মুমিনের জন্য আবশ্যক।( সূরা আন নিসা ১০৩ )



সালাত সম্পর্কে মহানবী সঃ ইরশাদ করেন, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত করবে্‌ পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করবে, রমজানে সাওম পালন করবেন, তোমাদের রবের ঘরের উদ্দেশ্যে হজ আদায় করবে, স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেকে সম্পদের যাকাত আদায় করবে, তাহলে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের জান্নাতে দাখিল হতে সক্ষম হবে।

সূচিপত্র

  • সালাতের নিষিদ্ধ সময়
  • সালাতের মাকরুহ সময় সমূহ
  • সালাতের আহকাম
  • সালাতের আরকান
  • সালাতের যেসব কাজ মাকরুহ
  • সালাত আদায় না করার পরিণাম
  • সালাত ফরজ হওয়ার শর্ত সমূহ
  • বালক বালিকার সালাত
  • নফল সালাত
  • শেষ কথা

সালাতের নিষিদ্ধ সময়

 তিন সময় সালাত আদায় করা নিষিদ্ধ। এই তিন সময়ে সালাত আদায় নিষিদ্ধ সময় গুলো উল্লেখ করা হলো। 
১।  সূর্যোদয়ের সময়
২ । ঠিক দুপুরের সময় ও 
৩। সূর্যাস্তের সময়
হযরত উকবা ইবন আমের ( রাঃ) বর্ণিত হাদিসে আছে, তিনি বলেন্‌ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম আমাদেরকে নির্ধারিত তিনটি সময়ে সালাত আদায় করতে নিষেধ করেছেন সেগুলো হল সূর্যোদয়ের সময় যতক্ষণ না সূর্য উপরে উঠবে প্রায় ২৩ মিনিট। হলে পরে এমন সময় যতক্ষণ না পূরণ হলে পরে এবং সূর্যাস্ত যাবার সময় সব ধরনের সালাত এবং  তেলাওয়াতের সিজদা নিষিদ্ধ। 


 সালাতের মাক্রুহ সময় সমূহ
1 । সূর্যের রং পরিবর্তন হয়ে গেলে আসরের সালাত আদায় করা।
2।  মাগরিব সালাতের ওয়াক্ত শুরু হলে গরী মুশরি পরে খালাত আদায়ের দেরি করা।
3। এশার মাকরূহ সময় হলো মধ্যরাতের পর হতে সুবহে সাদিক পর্যন্ত। তবে ভিতরের সালাত এশার পর হতে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আদায় করা যায়। এতে কোন মাক্রুহ ওয়াক্ত নেই ।
4।  দীনি গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে যদি সালাতের মাকরূহ ওয়াক্ত এসে যায়, তবে তা মাক্রম হিসেবে গণ্য হবে না। যেমন কুরআন মাজীদের তাফসীর, হাদিস দরসে মাসায়েল আলোচনা ইত্যাদি তবে সকলের উচিত সকল মাহফিল ও দরসে প্রোগ্রামের যতটা সময়ে সালাত আদায় করা।   যে সকল সময়ে সালাত আদায় করা মাকরূহ উল্লেখ করা হয়েছে, সে সবসময় কুরআন দুরুদ শরীফ ইস্তেগফার জিকির আজগর করা  মাক্রুহ নয়।  জুম্মা ,ঈদ , কুসুখ ,হজের খুতবা যখন ইমাম দাঁড়ান, তখন নফল সালাত আদায় করা মাত্র ঈদের দিনে ঈদগায়ে নফল সালাত আদায় করা মাক্রুহ।

সালাতের আহকাম

 সালাত শুরুর পূর্বে  সাতটি ফরজ কাজ সম্পন্ন করতে হয়। এগুলোকে সালাতে আহকাম বলা হয়। আহকাম গুলো উল্লেখ করা হল

  1. শরীর পাক হওয়া।
  2. কাপড় পাক হওয়া।
  3. সালাতের স্থান পাক হওয়া।
  4. সতর আবৃত ঢাকা।
  5. কেবলামুখী হয়ে  দাঁড়ানো।
  6. নিয়ত করা।
  7. ওয়াক্ত মত সালাত আদায় করা।

সালাতের আরকান

ভেতরে ছয়টি কাজ করতে হয় এগুলোকে সালাতের আরকান বলা হয় সালাতের আরকান গুলোর উল্লেখ করা হলো
  1. তাকবীরে তাহরীমা বলা।
  2. কিয়াম করা।
  3.  কিরাত পড়া।
  4. রুকু করা।
  5. সেজদা করা।
  6. শেষ বৈঠকে বসা।

সালাতে যেসব কাজ মাকরুহ

  1. ঘন ঘন বা তাড়াতাড়ি সেজদা করা।
  2. সালাতে আকাশের দিকে তাকানো।
  3.  পেশাব পায়খানায় ব্যাক দিয়ে সালাত পড়া।
  4.  সামনে নিয়ে সালাত পড়।
  5. শেষ দেয় দুই হাতে কোন মাটিতে বিছিয়ে দেওয়া ।
  6. এমন কিছুর দিকে মুখ করে সালাত করা যার দ্বারা মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে।
  7. কাপড় রুমাল ইত্যাদি গলায় ঝুলিয়ে সালাত পড়া।
  8. ঘুমের চাপ নিয়ে সালাত পড়া।
  9. সালাতের জন্য মসজিদের বিশেষ স্থান নির্ধারণ করা।
  10. কোন সূরা কে বিশেষভাবে কোন সালাতের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা
  11. সালাতের মধ্যে আঙ্গুল মোটকানো বা একহাতের আঙ্গুল অন্য হাতের আঙ্গুলের মাঝে প্রবেশ করানো

সালাত আদায় না করার পরিণাম

মুসলিম নারী পুরুষ সকলের জন্য সালাত লঙ্ঘনকারী ফরজ। শরীয়তসম্মত ওজ ও ছাড়া সালাত তরফ করা জায়েজ নাই বরং হারাম। হওয়াকে অস্বীকার করলে কাফির বলে গণ্য হবে। সালাত আদায় করা ঈমানদার ও মুসলমান হওয়ার বড় প্রমাণ । রসুলে করিম ইরশাদ  করেন মাঝে পার্থক্য হচ্ছে ,সালাত করা উচিত চরম সংকটের দিনের কথা সে যেদিন তোমাদেরকে আহবান করা হয়েছে। সেজদা করার জন্য কিন্তু তারা তা করতে সক্ষম হবে না ।তাদের কে আচ্ছন্ন করবে অথচ যখন তারা দুনিয়াতে নিরাপদ ছিল তখন সে তো তাদেরকে আহবান করা হয়েছিল সেজদা করতে।
আচ্ছা পূর্বক ফরজ সালাত ত্যাগ করা সামান্য ও নগণ্য গুনাহ হয়। এটা জঘন্য কাজ যা আল্লাহর বিরোধিতামূলক একটি অতি বড় অপরাধ। হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাঃ বলেন একদিন রাসুল সাঃ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন যে লোক সালাতে সঠিকভাবে ও যথাযথ নিয়মে আদায় করতে থাকবে তার জন্য কিয়ামতের দিন একটি নূর, অকাট্য দলিল এবং পণ্য নাজাত অবধারিত হবে। আর যে লোক সালাত সঠিকভাবে আদায় করবে না তার জন্য নূর, এবং মুক্তি কিছুই হবে না। বরং কেয়ামতের দিন তার পরিণাম হবে কারুন, ফেরাউন্‌ হামান ও উবাই খালফের মতো। 


সালাত ফরজ হওয়ার শর্ত সমূহ

সালাত ফরজ হওয়ার শর্ত পাঁচটি যথা
 1 .মুসলমান হওয়া ।
2 . প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া ।
ছেলে মেয়েদের সাত বছর বয়স হলে তাদেরকে সালাতে অভ্যস্ত করে তোলা পিতা মাতার ওপর ওয়াজিব। দশ বছর বয়সে যদি ছেলে মেয়ে সালাত আদায় না করে প্রথমে বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। যদি তাতেও কোন পরিবর্তন না হয়, তবে কঠোরতা অবলম্বন করে হলেও সালাত পড়াতে হবে।
 3 . সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন হওয়া।
 4 . মহিলাদের অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হওয়া।
5 . সালাতের ওয়াক্ত হওয়া।
কাফির মুসলমান হলে নাবালেক মালেক হলে পাগল সুস্থ হলে এবং মহিলারা থেকে পবিত্রতা হওয়ার পর কোন চালাতে তাকবীর সময় বাকি থাকলে সে ওয়াক্তের সালাত আদায় করা তাদের উপর ফরজ। রুগ্ন, খোঁড়া , আতুর, বোবা, বধির যে যে অবস্থায় আছে তাকে সে অবস্থায় সালাত আদায় করতে হবে।

বালক বালিকার  সালাত

অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক ও বালিকর উপর সালাত ফরজ নয়। তবে তাদেরকে এ ফরজ আদায়ের অভ্যস্ত করে তোলা বাবা-মার অভিভাবকের ওপর ফরজ। ৭ বছর বয়সে উপনীত হলে তাদেরকে সালাতে অভ্যস্ত করতে হবে এ সময় আদর যত্ন করে  ছেলেদের পিতা এবং মেয়েদের মাথা নিজেদের সাথে রেখে সালাতের তালিম দিতে হবে। দশ বছর বয়সে বয়সের সময় ছেলে বা মেয়ে সালাত আদায় করতে না চাইলে জোর করে হলেও সালাতে হাজির করতে হবে। প্রয়োজনে কঠোরতা অবলম্বন করে সালাতের অভ্যস্ত করতেই হবে।
 এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ ও ইরশাদ করেন, "তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে সাত বছর বয়সের সময় সালাতের আদেশ দাও ১০ বছর বয়সের সময় সালাতের জন্য স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা করো এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দাও।"
বালকদের মসজিদে সালাত আদায় করতে গিয়ে যেন কোন মুসলিম অসুবিধা না হয় সেদিকে খেয়াল করতে হবে। জামাতের সালাত আদায় করার সময় ভালো করা বড়দের সাথে দাঁড়াবে না। পেছনের কাতারে বা পাশে দাঁড়াবে। জামাত যদি শুরু হয়ে যায়, বালক যদি নিয়ত করে ফেলে এমন অবস্থায় তাকে পেছনে টেনে আনা জায়েজ নেই।

নফল সালাত

সালাতের পাশাপাশি নবী করিম বিভিন্ন সময়ের যে সকল সালাত আদায় করেছেন সেগুলোকে নফল সালাত বলা হয়। তবে ইসলামের পরিভাষায় সুন্নত সালাত কে নফল হিসেবে গণ্য করা হয় যেমন তাহিয়াতুল ওযু, পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পূর্বে ও পরে নফল সালাত ইত্যাদি।

1. তাহিয়াতুল অজুঃ
ওযু করার পর ওজুর পানি শুকানোর পূর্বে দু'রাকাত বা চার রাকাত মুস্তাহাব সালাত কে তাহিয়াতুল অজু বলা হয়। হযরত বর্ণনা করেন যে উত্তমরূপে অজু করে তারপর পুণ্য মনোযোগের সঙ্গে দু'রাকাত সালাত আদায় করবে তার জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে যাবে।

2 .তাহিয়াতুল মসজিদঃ
মসজিদ আল্লাহর ঘর। এ ঘরে প্রবেশের পরেই আল্লাহর দরবারে সেজদা গত হওয়া উচিত। সুতরাং মসজিদের প্রবেশের পরে যে দোয়া রাকাত দু'রাকাত যে প্রবেশের পরে যে দুই রাকাত নফল সালাত আদায় করা হয়, তাকে তাহিয়াতুল মসজিদ বলা হয়। রাসূলুল্লাহ সালাতে গুরুত্বরোপ করে বলেন, তোমাদের মধ্য থেকে কেউ মসজিদের প্রবেশ করলে দুই রাকাত সালাত আদায় করার আগে বসবে না। তাহিয়্যাতুল মুষ্টের সালাত ওই ব্যক্তির জন্য সুন্নত যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করবে।

3 .পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পূর্বে ও পড়ে নফল সালাতঃ
পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা ফরজ। এ সকল ফরজের পূর্বে ও পরে 12 রাকাত নফল সালাত আদায় করার জন্য প্রিয় নবী তাগিদ দিয়েছেন। উম্মুল মুমিনের হযরত উম্মে হাবিবা বর্ণনা করেন, যে ব্যক্তি দিনে রাতে 12 রাকাত সালাত আদায় করবে, জান্নাতে তার জন্য একটি গৃহ নির্মাণ করা হবে। তা হলো জোহরের ফরজের পূর্বে চার রাকাত, জোহরের ফজরের পর দুই রাকাত্‌ , মাগরিবের ফরজ সালাতের পর দুই রাকাত, এশার ফরজ সালাতের পর দুই রাকাত, আর ফরজের ফরজ সালাতের পূর্বে দুই রাকাত।

শেষ কথা

মানুষ শিক্ষিত হতে পারে, ধনী হতে পারে, নেতা হতে পারে্, মেধাবী হতে পারে কিন্তু সে যদি উত্তম সালাত আদায় এর অধিকারী না হয়ে মিথ্যাবাদী , প্রতারক, কৃপণ, বদমেজাজি হয় তাহলে সমাজে ও পরিবারের কোন মূল্য থাকে না। সে যেমন মানবকূলে অমানুষ তেমনি পরকালেও তার জন্য কঠিন শাস্তির অপেক্ষা করছে । জান্নাত তার জন্য হারাম হয়ে জাহান্নাম তার জন্য অপেক্ষা করছে। তাই আমাদের যথাসময়ে সালাত আদায় করা উত্তম এবং আল্লাহর দেওয়া বিধি-বিধান গুলো অন্তর থেকে মেনে নেওয়া উচিত। আল্লাহ তাআলা আমাদের সঠিক সময়ে সালাত আদায় করার তৌফিক দান করুন।





 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url